আধ্যাতিক রাহবার যুগ শেষ্ট সাধক হযরত বাহলুল (রহ.) একদিন বছরার কোনাে এক রাস্তা দিয়ে হাটছেন। আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মাঝে তিনি দৃষ্টি ফেলে খোঁজে পান আত্মার প্রশান্তি। আল্লাহ পাক তাঁর অলীর হৃদয়ে তুলে ধরেন তাঁর সৃষ্টির বড়ত্বের নিদর্শন । চোখের সামনে তুলে ধরেন মহনীয় কুদরত । তেমনি হযরত বাহলুল (রহ.)-এর দৃষ্টি একটি জায়গায় যেয়ে থেমে যায়। চোখে পড়ে কয়েকটি শিশু-কিশাের এক সাথে আখরােট অথবা বাদাম দিয়ে খেলা করছে। আর তাদের পাশেই একা একটি কিশাের মাটির দিকে তাকিয়ে কাছে। হযরত বাহলুল (রহ.) বলেন। ছেলেটির হয়তাে বাদাম নেই এ জন্য কাছে। তিনি ছেলেটির কাছে গেলেন, হে কিশাের! তুমি মাটির দিকে তাকিয়ে কাদছাে কেন? তােমাকেও আমি বাদাম কিনে দেবাে, উহা দ্বারা তুমি তাদের সাথে খেলতে পারবে । ছেলেটি হযরত বাহলুল (রহ.)-এর দিকে তাকিয়ে আরাে কেঁদে উঠলাে এবং বলতে লাগলাে- আরে বে-কুফ! “আমরা এ মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছি, আবার এ মাটির সাথেই মিশে যেতে হবে । এ দুনিয়াতে আমরা কি খেলতামাশার জন্য পয়দা হয়েছি”? হযরত বাহলুল (রহ.) অবাক চাহিনীতে বললেন, কিসের জন্য পয়দা হয়েছ? সে বললাে, এলেম হাসিল ও এবাদতের জন্য । তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা তােমার হায়াতের মাঝে বরকত দান করুন । তুমি কোথায় পেলে এই কথা! | ছেলেটি বললাে- পবিত্র কুরআনে পাকে বর্ণিত আছে, “তােমরা মনে কর নাকি আমি তােমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি। আর তােমরা আমার নিকট ফিরে আসবে না”? এ বালকের কথা শােনে তিনি আশ্চর্য্য হতে লাগলেন, পুলকিত হলেন। এ ছােট্ট ছেলের মুখে এত দামি কথা! নিশ্চয় তার ভিতরে হয়তাে লুকিয়ে আছে হারানাে মণি-মুক্তা! তাই তাকে তিনি বললেন, বেটা! তুমি বড় বুদ্ধিমান মনে হয়, আমাকে কিছু নসিহত করাে, তখন সে চারটি শেষ পড়লাে, যার অর্থ হলাে এইআমি দুনিয়াকে দেখতেছি সব সময়ই সে দ্রুত কদমে প্রস্থান করতেছে। কোনাে জীবিতদের জন্য দুনিয়া বাকী থাকে না। মনে হচ্ছে যে, মৃত্যু এবং মসিবত দুই দ্রুতগামী ঘােড়া মানুষের দিকে দৌড়িয়ে আসছে । সুতরাং হে বে-কুফ! দুনিয়ার মধ্যে যে কোন ধােকায় পড়ে আছাে? একট। চিন্তা কর ও আখেরাতের জন্য এখান থেকে কিছু পাথেয় সংগ্রহ কর । অতঃপর ছেলেটি আসমানের দিকে হাত উঠিয়ে দু’টা বয়াত পড়লাে, এবং তার চোখ হতে অনবরত অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগলােকবিতার দুটি লাইনের বঙ্গানুবাদ হলােহে জাতে পাক! যার দিকে নত জানু হতে হয়, আর তার উপরই ভরসা। করা হয়। হে পাকে জাত! যার উপর বিশ্বাস স্থাপন করলে কেউ অকৃতকার্য হয়।
এতটুকু পড়ে সে বেহুশ হয়ে পড়ে গেলাে। হযরত বাহলুল (রহ.) তাড়াতাড়ি তার মাথা নিজের কোলে তুলে নিলেন। তার মুখে লেগে থাকা বিভিন্ন মাটি-বালি ঝেড়ে ফেলে পরিষ্কার করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর ছেলেটির হুশ ফিরে আসলাে। হযরত বাহলুল (রহ.) জিজ্ঞাসা ভঙ্গিতে বললেন, এত অল্প বয়সেই তােমার অন্তরে এত ভয় ঢুকে পড়েছে? অথচ এখনাে তােমার আমলনামায় কোনাে পাপ লেখা হয়নি। তারপরও এত ভয় তােমার!
সে বললাে- হে বাহলুল! চলে যাও, চলে যাও, আমি আমার আম্মাকে। দেখেছি । আগুন জালানাের জন্য সব সময় ছােট ছােট লাকড়ির টুকরাগুলাে। চুলায় আগে প্রবেশ করান। তারপর বড় লাকড়ি দেন। আমার ভয় হচ্ছে। জাহান্নামে ঐ ছােট লাকড়ির মত আমাকেও প্রথম স্থানে রাখা হয় নাকি! হযরত বাহলুল (রহ.) বললেন, বেটা! তােমাকে বড় বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। আমাকে কিছু মুখতাছার নসিহত কর । কবিতার মাধ্যমে চৌদ্দটি নসিহত করলাে। তা নিমে তুলে ধরা হলাে
১. আমি গাফলতের মধ্যে পড়ে আছি, অথচ মৃত্যুর চালক মৃত্যুকে আমার দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে আসছে ।
২. আজ নয় কাল নিশ্চয় আমি চলে যাবাে ।
৩. আমার শরীরকে নরম পােশাকের দ্বারা সজ্জিত করে রেখেছি। অথচ আমার শরীর পচে গলে যাওয়া ছাড়া কোনাে গন্তব্য নেই।
৪. সে দৃশ্য আমার সম্মুখে রয়েছে যখন আমি কবরে পচে গলে পড়ে থাকবাে ও নিচে হবে কবরের গহবর, আর আমার এ সৌন্দৰ্য্য ধুলিসাৎ | হয়ে যাবে। এমনকি কোনাে মাংস অথবা চামড়া থাকবে না ।
৫. আমি দেখতেছি হায়াত শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ আমার আশা আকাংখা পূর্ণ হচ্ছে না এবং অনেক লম্বা সফর সামনে রয়েছে, অথচ সফরের সামানা কিছু বলতে কিছু নেই।
৬ আমি প্রকাশ্যে মনিবের সাথে গােনাহর দ্বারা মুকাবেলা করছি।
৭. বড় বড় অন্যায় করে ফেলছি যা ফিরিয়ে নেয়ারও কোনাে ব্যবস্থা। নেই, আমি পাপসমূহ লােক চক্ষু হতে গােপন রেখেছি, কিন্তু কাল হাশরের মাঠে মালিকের নিকট তা গােপন থাকবে না ।
৮. তাতে সন্দেহ নেই যে, তাঁর ভয় আমার মধ্যে ছিল, কিন্তু তাঁর অপরিসীম ধর্য্যের উপর ভরসা করতে ছিলাম যে, তিনি বড় ক্ষমাশীল।
৯. মৃত্য এবং মৃত্যুর পর পচে গলে যাওয়া ব্যতীত অন্য ভয় না থাকলেও জান্নাতের ওয়াদা ও জাহান্নামের ভয় না থাকলেও কবরে পচে গলে। যাওয়ার মধ্যে এই কথার উপর যথেষ্ট সতর্কতা ছিল, যেন খেল তামাশা থেকে বেচে থাকা যায় ।
১০. হায়! ক্ষমাশীল মাওলা! যদি আমার গােনাহ মাফ করে দিতেন?
১১. গােলাম অন্যায় করলে মাওলা ক্ষমা করতে পারে । নিশ্চয় আমি সৃষ্টির সেরা নালায়েক গােলাম, যার কোনাে কথাই ঠিক থাকে না ।
১২. হে মাওলা! যে অগ্নিকে পাথর বরদাশত করতে পারবে না, তা আমার শরীরকে স্পর্শ করলে কি অবস্থাই না হবে তখন ।
১৩. আমি মৃত্যুর সময়ই একা হয়ে যাবাে, কবরেও একা, কবর উঠবােও একা।
১৪. হে পাক জাত! তুমি একক তােমার কোনাে শরীক নেই। যে একা পড়ে আছে তার উপর রহম করুন। আল্লাহর অলী হযরত বাহলুল (রহ.) এই ছেলেটির বিস্ময়কর আত্মশুদ্ধির মধুমাখা আকর্ষণীয় নসিহতপূর্ণ কবিতা শােনে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে। গেলেন। দীর্ঘক্ষণ অচেতন অবস্থায় পড়ে রইলেন, যখন তার জ্ঞান ফিরে আসলাে তখন ঐ ছেলেটিকে আর দেখতে পেলেন না। ছেলেটি কোথায় যে হারিয়ে গেলাে! তিনি ছেলেটির সন্ধান নিতে লাগলেন, কোথায় সেই অপার্থীব জগতের গবেষক! আধ্যাতিক মহান সাধক! কোথায় আমার সপ্নের কিশাের! যে আমার হৃদয়ে করেছে তােলপাড়। করেছে নতুন। জাগরণ আমার আত্মার মাঝে । আমার ঘুমন্ত হৃদয়কে করেছে জাগ্রত । খোঁজতে লাগলেন, অন্যান্য ছেলেদেরকে তার কথা জিজ্ঞাসা করলে তারা বললাে- বাহলুল (রহ.) আপনি তাকে চিনেন না? সে তাে হযরত ইমাম হােসাইন (রা.)-এর আওলাদ। তিনি নিজেও অবাক ছিলেন ভাবলেন, নিশ্চয়ই এই ফল কোনাে উপযুক্ত বৃক্ষের হবে । (সূত্র : ফাজায়েলে আমাল)।
হৃদয়ের আহ্বান : প্রিয় পাঠক! কথায় আছে- “যেমন বৃক্ষ তেমন ফল। আমরা যদি আমাদের ছেলে মেয়েদের ছােট সময় থেকেই আধ্যাতিকতার তালীম দিয়ে আল্লাহ তায়ালার মহত্ব ও বড়ত্বের বুঝ অন্তরে প্রবেশ করাতে পারি, তাহলে সন্তান ও অভিভাবক উভয়ের দুনিয়া ও আখেরাত কামিয়াব । হে কিশাের-কিশােরী বন্ধুরা! আমরাও উপরক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে।
নিজের জীবনকে ঐ সব মহান ব্যক্তিদের মত সাজানাের চেষ্টা করি। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন!